বাংলাদেশে অনেকেই মাইগ্রেনের সমস্যায় ভোগেন। মাইগ্রেন একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা যা প্রতি ৫ জন নারীর মধ্যে একজনের এবং প্রতি ১৫ জন পুরুষের মধ্যে একজনের থাকে। এটা সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালের শুরু থেকেই হয়ে থাকে। আমাদের অনেকেরই মাইগ্রেনের মাথাব্যথা আছে। আবার অনেকে সাধারণ মাথাব্যথাকে মাইগ্রেনের ব্যথা বলে মনে করে।
মাইগ্রেন কি?
মাইগ্রেন হলো এক প্রকারের মাথাব্যথা যেটা মাথার অর্ধেক অংশে বা কোনো অংশে অনবরত মাথাব্যথার সৃষ্টি করে। এটা কিছু সময় থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে। এটা তীব্র পর্যায়ে হলে বমি বমি ভাব, এমনকি বমিও হতে পারে এবং সেই সাথে চোখে ব্যথা তো আছেই। এই ব্যাথার এখন পর্যন্ত সঠিক কারণ সেভাবে জানা যায় নি। তবে পরিবেশগত বা জেনেটিক কারণেও হতে পারে। সাধারণত অনেকেই স্বাভাবিক মাথা ব্যাথাকে মাইগ্রেনের মাথাব্যথা বলে মনে করে। অতিরিক্ত আলো বা রোদ কিংবা খুব কম আলো, অতিরিক্ত শব্দ কানে এলে এ সমস্যা হতে পারে মাইগ্রেনের সমস্যা হলে মাথার ভেতরে ব্যথা হয়। এই ব্যথা সাধারণত মাথার একদিকে হয়, ডান অথবা বাঁ দিকে। তবে অনেক সময় মাথার দুদিকেই ব্যথা হতে পারে।
মাইগ্রেন এর লক্ষণঃ
মাইগ্রেনের ব্যাথা শুরু হওয়ার এক বা দুই দিন আগে আপনি এর সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলি লক্ষ্য করতে পারবেন, যা আসন্ন মাইগ্রেনের লক্ষণ বলে ধরা হয়। সেগুলো হল –
আলো, শব্দ এবং গন্ধের প্রতি সংবেদনশীলতা, বমি বমি ভাব এবং বমি হওয়া, পেট খারাপ এবং পেটে ব্যথা, ক্ষুধামন্দা, খুব গরম বা ঠান্ডা অনুভব করা, ত্বকের রঙ ফ্যাকাশে হওয়া, ক্লান্ত বোধ, মাথা ঘোরা, ডায়রিয়া, জ্বর, বিরক্তি এবং বিষন্নতা ভাব, কথা বলতে এবং পড়তে অসুবিধা, ঘুমাতে অসুবিধা, হাঁপানি, প্রস্রাব বেড়ে যাওয়া, পেশী শক্ত হওয়া, সাময়িক দৃষ্টিশক্তি হারানো, শরীরের একপাশে দুর্বলতা, ঘাড় ব্যথা ও শক্ত হয়ে যাওয়া, নাক বন্ধ, অনিদ্রা, বিষণ্ণ মেজাজ ইত্যাদি।
মাইগ্রেনের ব্যাথা কেন হয়?
চোখ, কান, নাক ও চোয়ালের জয়েন্টে সমস্যা, দুশ্চিন্তা, ব্রেইন টিউমার, মাইগ্রেন, ঘুম কম হওয়া এবং দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটারে বসে থাকাসহ অনেক কারণে মাথাব্যথা হতে পারে। তবে মস্তিষ্কের পর্দা বা মেনিনজেসে কোনো সমস্যা হলে মাথার হাড়ের মধ্যকার সাইনাসে প্রদাহ (সাইনোসাইটিস) হলে কিংবা মস্তিষ্কের রক্তনালিতে কোনো সমস্যা দেখা দিলে মাথাব্যথা হয়ে থাকে।
তাছাড়া নিচে মাইগ্রেনের ব্যথার আরো কিছু কারণ দেওয়া হল –
পরিবেশগত অথবা বংশগত কারণেও হতে পারে।
অতিরিক্ত সময় রোদে থাকলে হতে পারে।
পরিমিত পরিমাণে বিশ্রাম না নিলে এবং কম পরিমাণে পানি খেলে।
বেশি শরীরচর্চা করলে।
মহিলাদের মধ্যে হরমোনের পরিবর্তন হলে।
হঠাৎ করে তাপমাত্রার পরিবর্তন হলে। ধরুন, আপনি অনেকক্ষণ এসি রুমে কাজ করে বের হয়ে আবারও এসি রুমে ঢুকলেন। সেসময় আপনি যদি অনেক কাজের চাপের মধ্যে থাকেন, তাহলে আপনার এই মাইগ্রেনের ব্যাথা হতে পারে।
অতিরিক্ত কাজের চাপ পড়লে এটা হতে পারে।
তীব্র আলো, প্রচণ্ড গরমে, অতিরিক্ত টেনশনে থাকলে ও অতিরিক্ত শব্দের মধ্যে থাকার কারণেও এটা হতে পারে।
খাবারে নির্দিষ্ট রাসায়নিক এবং প্রিজারভেটিভের প্রতি সংবেদনশীলতার ফলে।
দীর্ঘ সময় ভ্রমণে কম পরিমাণ পানি খেলে।
দেরি করে খাবার খেলে।
খালি পেটে থাকলে এবং কম পরিমাণ বিশ্রাম পেলে এই সমস্যা দেখা যায়।
এই পোস্টটি দেখতে পারেন – “অনিয়মিত খ্যাদাবাস শরীরে যে সকল প্রভাব ফেলে”
মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তার সাথে মাইগ্রেনের সম্পর্কঃ
যখন কেউ ভয়ানক এবং ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির স্বীকার হোন, যেমন হঠাৎ খুব মন্দ বা কষ্টকর সংবাদ পাওয়া, খুবই ঝামেলাপূর্ণ দিন অতিবাহিত করা ইত্যাদি কারণে মাইগ্রেনের ব্যথা তীব্র আকার ধারন করতে পারে। স্ট্রেস বা কঠিন মানুসিক চাপও এর বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। যখন কেউ স্ট্রেস বা কঠিন মানসিক চাপগ্রস্থ থাকে তখন শরীরের কিছু উপাদান ও হরমোনের মাত্রা হঠাৎ করে বেড়ে যায়। এর ফলেও মাইগ্রেনের ব্যথা বেড়ে যায়।
জেনে নিন – “মানসিক শান্তি কেন গুরুত্বপূর্ণ“।
যেসব খাবারে বাড়তে পারে মাইগ্রেনের ব্যাথাঃ
খাবারের প্রোটিনের মধ্যে টাইরামিন নামে রাসায়নিক পদার্থ থাকে যা মস্তিষ্কের রক্তনালির সংকোচন ঘটিয়ে মাইগ্রেনের ব্যথা বাড়ায়। টাইরামিন বেশি থাকে পনির, চকোলেট, রেড ওয়াইন, মেটে, সয়াসস, ডিম, কমলালেবু, ডুমুর, কলা, টম্যাটো, কিশমিশ ইত্যাদিতে। এগুলি মাইগ্রেন রোগীরা এড়িয়ে চলতে পারেন বা পরিমাণে কম খাবেন। তাছাড়া ফাস্ট ফুড জাতীয় খাবারে রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয় যা খাবারকে সুস্বাদু করে তুলে কিন্তু এই রাসায়নিক পদার্থের কারণে মাইগ্রেনের ব্যাথা সহ শরীরের অনেক ক্ষতি হয়। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে এই পোস্টটি দেখতে পারেন – “ফাস্টফুড বা জাঙ্ক ফুডের ক্ষতিকর দিক“। এছাড়া দুধ, চা, কফি, সাইট্রাস ফল পনির এগুলো খেলে মাথাব্যথা হয়। রেডমিট, চিংড়ি, কাঁকড়া, মাছের মাথা, মাছের ডিম, লিভার, কিডনি, ফুল ক্রিমযুক্ত দই, মিষ্টি দই, কনডেন্সড মিল্ক, সয়া মিল্ক, লেবু জাতীয় ফল, আনারস, নারকোলও বেশি খাওয়া যাবে না এবং কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার কম খেতে হবে।
আরো জানতে পারেন – “অতিরিক্ত চা, কফি পানের ক্ষতিকর দিক“।
মাইগ্রেনের চিকিৎসাঃ
প্রতিরোধক ঔষুধের পাশাপাশি দৈনন্দিন কিছু নিয়মকানুন মেনে চললে সমস্যাটি অনেকাংশে কমিয়ে রাখা যায়। এগুলো হল –
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ও পরিমিত পরিমাণে ঘুমাতে হবে ।
কম বা অতিরিক্ত আলোতে কাজ করা যাবেনা।
তীব্র রোদ বা ঠান্ডা পরিহার করতে হবে।
কোলাহলপূর্ণ ও উচ্চশব্দ সম্পন্য পরিবেশে বেশিক্ষণ থাকা যাবেনা।
একাধারে ও অধিক সময় কম্পিউটারের মনিটর ও টিভির সামনে থাকা যাবেনা।
মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হলে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে।
বমি হলে বিশ্রামসহ মাথায় ঠান্ডা কাপড় জড়িয়ে রাখতে হবে।
অতিরিক্ত টেনশন করা যাবেনা।
অধিক রাত জাগা যাবেনে৷
হাসি-খুশি থাকার চেষ্টা করতে হবে ও জীবনের আনন্দকে উপভোগ করতে হবে৷
পুষ্টিযুক্ত খাবার যেমন, তাজা শাকসবজি, ফল, কম ফ্যাটযুক্ত চিকেন, মাছ গ্রহণ করলে এর প্রকোপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। যে খাবারে ওমেগা-৩-ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায় যেমন স্যামন ফিশ, ফ্ল্যাক্সসিড, আখরোট, ভুট্টা খেলে ব্যথার উপশম হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণে জল বা জলীয় পদার্থ যেমন স্যুপ খাওয়া যেতে পারেন। ডিহাইড্রেশন হলে মাইগ্রেনের ব্যথা বাড়ে। সবুজ শাকসবজি, পালংশাক এগুলি ম্যাগনেশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার যা মাইগ্রেন কমাতে সাহায্য করে। গ্রিন টি, আদা চা, ক্যামোমাইল চা ব্যথা কমাতে ভালো কাজ করে।
নিচের পোস্টগুলো দেখতে পারেনঃ
পুষ্টিকর খাবার তালিকা ও এর প্রয়োজনীয়তা
দৈনিক কত ক্যালরী খাদ্য প্রয়োজন?
গ্রিন টি – সবুজ চায়ের উপকারিতা
মাইগ্রেন থেকে দূরে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপায় হচ্ছে নিয়মানুবর্তী থাকা ও ঘুমের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া, তীব্র আলো বা শব্দ থেকে দূরে থাকা। নিজের কাজের মধ্যে গতিশীলতা খুঁজে বের করার করা। এই মাইগ্রেনের সমস্যা চিরতরে সাড়ানো যায় না তবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। চিকিৎসার ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কেউ ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত মোটেও কোনো ওষুধ খাবেন না। এছাড়া অনেক জার্নালে উল্লেখ করেছে যে, দীর্ঘদিন যাবৎ মাইগ্রেনের ঔষুধ মানুষকে মোটা হওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাবিত করে। তবে তীব্র মাইগ্রেনের মাথাব্যথা হলে, সঠিকমাত্রায় ঘুমানো উচিত ও মাথায় বরফ লাগালে দ্রুত উপকার পাওয়া যেতে পারে।
সংগৃহীত
Leave a Reply