মধু (Honey) একটি প্রাকৃতিক মিষ্টি যা বহু শতাব্দী ধরে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি ফুলের অমৃত থেকে মৌমাছি দ্বারা উৎপাদিত হয় এবং এর একটি জটিল রাসায়নিক গঠন রয়েছে যার মধ্যে শর্করা, এনজাইম, অ্যামিনো অ্যাসিড, ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। মধু শুধু সুস্বাদু নয়, এটি স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত উপকারী একটি উপাদান। মধু খেলে শরীরের অনেক উপকার হয়।
পুষ্টিগুণের দিক দিয়ে বিবেচনা করে যদি আমরা খাবারের একটি তালিকা করি, সে তালিকার প্রথম সারিতেই থাকবে ‘মধু’র নাম। এটি শরীরের জন্য উপকারী এবং নিয়মিত মধু সেবন করলে অসংখ্য রোগবালাই থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। এটি বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রমাণিত।
কালিজিরা যেমন শতগুণে ভরপুর ঠিক তেমনি মধুও অসংখ্য গুণে ভরপুর। কালিজিরা নিয়ে বিস্তারিত জানতে এই পোস্টটি দেখতে পারেন – “কালিজিরা – একটি প্রাকৃতিক মহৌষধ“।
মধুর মধ্যে কি কি উপাদান রয়েছে?
মধুতে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান থাকে। ফুলের পরাগের মধুতে থাকে
গ্লুকোজ ২৫ থেকে ৩৭ শতাংশ
ফ্রুক্টোজ ৩৪ থেকে ৪৩ শতাংশ
সুক্রোজ ০.৫ থেকে ৩.০ শতাংশ
মন্টোজ ৫ থেকে ১২ শতাংশ
অ্যামাইনো অ্যাসিড ২২ শতাংশ
খনিজ লবণ ২৮ শতাংশ
এনকাইম ১১ শতাংশ
মধুতে চর্বি ও প্রোটিন নেই। প্রতি ১০০ গ্রাম মধুতে থাকে ২৮৮ ক্যালরি।
বিভিন্ন ধরনের মধুঃ
বাংলাদেশে অনেক ধরনের মধু পাওয়া যায়। এর মধ্যে সুন্দরবন মধুর জন্য শ্রেষ্ঠ স্থান। এখানকার মধুগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সেরা হানিপ্ল্যান্ট গাছের খলিসা ফুলের মধু বা পদ্ম মধু। খলিসা ফুল হয় সাদা আর এর মধুর রং বেশ গাঢ় এবং খুব কড়া ও মিষ্টি স্বাদযুক্ত। ফাল্গুন মাস অর্থাৎ মার্চ থেকে এপ্রিলে এই মধু পাওয়া যায়।
তাছাড়া সরিষা ফুলের মধু, লিচু ফুলের মধু, কালিজিরার মধু ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের মধুই পাওয়া যায় বাংলাদেশে।
মধুর বিভিন্ন উপকারিতাঃ
সংক্রমণ রোধ করেঃ
সাইনাসের মতো সমস্যায় দারুণ কার্যকরী একটি উপাদান হতে পারে মধু। মধুতে থাকা অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল যৌগ সংক্রমণ দূর করতে সাহায্য করে। সেইসঙ্গে প্রদাহও কমিয়ে দেয়। তাই যাদের সাইনাসের মতো সমস্যা রয়েছে তারা নিয়মিত সকালে এক চামচ করে মধু খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন। এতে দ্রুত উপকার পাবেন।
শ্বাসকষ্ট দূরে রাখেঃ
শ্বাসকষ্টের সমস্যা দূরে রাখতে মধু বেশ কার্যকর। অনেকেই সর্দি-কাশির কারণে শ্বাসকষ্ট হলে লেবুর সঙ্গে মধু মিশিয়ে পান করেন। শ্বাসকষ্ট ছাড়াও ফুসফুসের অনেক সমস্যা দূর করতে কাজ করে মধু। শ্বাসকষ্টের সমস্যায় মধু নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ নিলেও আরাম পাওয়া যায়। বছরখানেকের পুরনো মধু খেলেও এই ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে আরাম হয়।
এছাড়াও পুদিনা পাতা এই ধরনের রোগীদের জন্য বেশ উপকারি। বিস্তারিত এই পোস্টে – “পুদিনা পাতা (Mint Leaves) এর উপকারিতা ও অপকারিতা“।
ওজন কমাতে সাহায্য করেঃ
মধুতে কোন চর্বি নেই। তাছাড়া মধু পেট পরিষ্কার এবং চর্বি কমায়। এর ফলে নিয়মিত মধু খেলে আপনার আপনার ওজন কমতে থাকবে। তাছাড়া মধুর উপাদানগুলি হজম শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। নিয়মিত মধু খেলে আপনার বদ হজম দূর হবে।
অনিদ্রা ও ঘুমের জন্য সহায়কঃ
মধু ঘুমের জন্য খুবই উপকারি। রাতে ঘুমানোর আগে একটু মধু খেলে আপনার অনিদ্রা চলে যাবে এবং আপনার ভাল ঘুম হবে। তাই মধুকে ঘুমের ঔষধও বলা যেতে পারে। শরীর ও স্বাস্থ্য ভালো রাখতে কাজের পাশাপাশি বিশ্রামের একান্ত প্রয়োজন।
স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করেঃ
মধুর অনেক স্বাস্থ্য সুবিধার মধ্যে একটি অন্যতম গুণ হলো স্মৃতিশক্তি এবং মনোযোগ উন্নত করতে সহযোগিতা করে। মধু খাওয়া শুধুমাত্র স্মৃতিশক্তি এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করতে পারে না, এটি আপনার সাধারণ স্বাস্থ্যেরও উন্নতি করে। মধুর অন্তর্নিহিত অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং থেরাপিউটিক বৈশিষ্ট্যগুলি কোলিনার্জিক সিস্টেম, রক্ত প্রবাহ এবং মস্তিষ্কের স্মৃতি-ক্ষয়কারী কোষগুলিকে বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।
ত্বকে পুষ্টি যোগায়ঃ
স্কিন কেয়ার প্রোডাক্টে কয়েক শতাব্দী ধরে মধু ব্যবহার হয়ে আসছে। এটিতে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা ব্রণ এবং অন্যান্য ত্বকের অবস্থা কমাতে সাহায্য করতে পারে। মধুতে ময়শ্চারাইজিং বৈশিষ্ট্যও রয়েছে যা ত্বককে হাইড্রেট করতে এবং ত্বকের গঠন উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে।
জেনে নিন – “শীতে ত্বকের যত্নে কিছু টিপস“।
শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করেঃ
মধু হল কার্বোহাইড্রেটের একটি প্রাকৃতিক উৎস, যা দ্রুত শক্তির উৎস প্রদান করতে পারে। এটি অ্যাথলিট এবং সক্রিয় ব্যক্তিদের জন্য একটি দুর্দান্ত বিকল্প যাদের ওয়ার্কআউটের পরে তাদের শরীরকে জ্বালানী করতে হবে। মধুতে ভিটামিন এবং খনিজ রয়েছে, যেমন আয়রন এবং ম্যাগনেসিয়াম, যা শক্তির মাত্রা সমর্থন করতে সাহায্য করতে পারে।
সর্দি, কাশি উপশম করেঃ
সর্দি-কাশির প্রাকৃতিক প্রতিকার হিসেবে মধু বহু শতাব্দী ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটিতে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা গলাকে প্রশমিত করতে এবং কাশি কমাতে সাহায্য করতে পারে। মধুর উপকারিতা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং ঠান্ডা উপসর্গের সময়কাল ও তীব্রতা কমাতেও সাহায্য করতে পারে।
হার্ট ভালো রাখেঃ
কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের উপর মধুর উপকারিতা ইতিবাচক প্রভাব দেখানো হয়েছে। এটি LDL কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমাতে দেখানো হয়েছে, যা হৃদরোগের ঝুঁকির কারণ। মধুতে প্রদাহ বিরোধী বৈশিষ্ট্যও রয়েছে যা ধমনীতে প্রদাহ কমাতে এবং রক্ত প্রবাহ উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। মধুতে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা কোষের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
ক্ষত নিরাময়ঃ
আয়ুর্বেদের মতো প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি অনুযায়ী ক্ষত নিরাময়ে ত্বকে সরাসরি মধু ব্যবহার করা হতো। মধুর ব্যাকটেরিয়ারোধী উপাদান এবং সংক্রমণ সৃষ্টিকারী জীবাণুর বৃদ্ধি রোধে এর সক্ষমতার কারণে এমনটি করা হতো।
এছাড়াও মধু আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম ভাল রাখে, এলার্জি কমাতে সাহায্য করে, ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে এবং আরো অনেক উপকার করে থাকে।
মধুর অপকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াঃ
চিনির বিকল্প হিসেবে মধু নিঃসন্দেহে খুবই স্বাস্থ্যকর কিন্তু তার মানে এটা বোঝায় না যে মধু একেবারেই চিনিমুক্ত। মধুতে থাকে চিনি ও শর্করা, তাই অতিরিক্ত মধু খেলে রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের খাদ্যতালিকায় এটি অন্তর্ভুক্ত করার আগে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে অবশ্যই কথা বলে নেয়া উচিত।
অতিরিক্ত মধু খাওয়া প্রতিদিনের ক্যালরির পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে। এটি শরীরের ওজন বৃদ্ধির দিকে ধাবিত করবে।
মধুতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে ঠিক কিন্তু অতিরিক্ত মধু খাওয়া নিম্ন রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।
মধুর মত আঠালো পদার্থ অতিরিক্ত মুখে নেয়া হলে অধিক পরিমাণ চিনি মুখের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। এটি দাঁতের সঙ্গে লেগে থেকে দাঁতের ক্ষয় করতে পারে।
যাদের মধুতে অ্যালার্জি আছে তাদের প্রচণ্ড পেট ব্যথা, বদ-হজম ও ডায়রিয়া হতে পারে।
প্রতিদিন অত্যধিক মধু খেলে পেটে ব্যথাও হতে পারে। তাই যারা প্রতিদিন মধু খান, তারা পরিমাণটা সীমিত রাখুন।
অত্যধিক মধু খাওয়ার আরেকটি প্রতিকূল প্রভাব হল কোষ্ঠকাঠিন্য। প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১০ চা চামচ মধু খেতে পারেন। এর থেকে বেশি হলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
সংগৃহীত
Leave a Reply