রক্তশূন্যতা বা Anemia নিয়ে বিস্তারিত

রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়া (Anemia) আমাদের দেশের নারীদের কাছে একটি অতি পরিচিত নাম। শুধু নারী কেন পুরুষেরাও অ্যানিমিয়ার শিকার হয়ে থাকেন। তবে বিভিন্ন সার্ভেতে দেখা গিয়েছে নারীদের সংখ্যাটাই যেন বেশি। বর্তমান বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়ায় ভুগেন এবং ক্রমেই এই রোগাক্রান্তের হার ও মৃত্যুহার বেড়েই চলছে। এটি মানুষের কর্মক্ষমতা তাৎপর্যপূর্ণ হারে কমিয়ে দেয় এবং স্নায়ুবিক বিকাশে বাধাপ্রদান করে। আমাদের দেশেও রক্তস্বল্পতা একটি অতি-পরিচিত স্বাস্থ্য সমস্যা। আপনার শরীরের রক্তে যখন রেড ব্লাড সেল বা হিমোগ্লোবিন কমে যায় তখন সেই অবস্থাকে অ্যানিমিয়া বলে। হিমোগ্লোবিন রক্তের একটি বিশেষ রঞ্জক পদার্থ। এর প্রধান কাজ হল শরীরের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন সরবরাহ করা। হিমোগ্লোবিন রক্তের লোহিত কণিকায় থাকে। তাই লোহিত রক্ত কণিকা কমে গিয়েও রক্তশূন্যতা হতে পারে। এই পরিস্থিতির সম্মুখীন তখনই হতে হয় যখন শরীরে আয়রনের অভাব হয়। রক্তে অপর্যাপ্ত পরিমাণ আয়রনের কারণে আমাদের দুর্বল লাগে, বমির ভাব আসে, সারাদিন ঘুমঘুম ভাব থাকে আর চেহারা হয়ে যায় ফ্যাকাসে। আমার আজকের পোস্টে রক্তশূন্যতার কারণ, লক্ষণ, প্রতিকারের উপায় ইত্যাদি কিছু বিষয় সম্পর্কে জানব।

রক্তশূন্যতা আসলে কি?

অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা নিয়ে আমরা পোস্টের শুরুতেই একটি ধারণ পেয়ে গিয়েছি। Anemia তখন ঘটে যখন শরীরে স্বাস্থ্যকর লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা খুব কম থাকে। এটি একটি সমস্যা কারণ লোহিত রক্তকণিকা শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন (Oxygen) পরিবহনের জন্য দায়ী। যেমন, কম আরবিসি গণনার ফলে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কম হবে। বিভিন্ন অঙ্গ ও টিস্যুতে অক্সিজেন সরবরাহের অভাবের কারণেই রক্তশূন্যতার লক্ষণ দেখা দেয়। অ্যানিমিয়া হল সবচেয়ে সাধারণ রক্তের ব্যাধি, সারা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১/৩ জন এই রোগের কোনো না কোনো রূপ প্রদর্শন করে। অ্যানিমিয়া নির্ণয় করা হয় যখন হিমোগ্লোবিনের মাত্রা পুরুষদের জন্য 13.5 গ্রাম/100 মিলি এবং মহিলাদের জন্য 12.0 গ্রাম/100 মিলি-এর নিচে থাকে। হিমোগ্লোবিন হল RBC এর প্রোটিন যা বিভিন্ন অঙ্গ ও টিস্যুতে অক্সিজেন বহন করার কাজ করে।

রক্তশূন্যতার প্রকারভেদঃ

অ্যানিমিয়া শ্রেণীবিভাগের ক্ষেত্রে ৩টি ভাগ থেকে করা যেতে পারে। এগুলো হল – লাল কোষের রূপবিদ্যা, ক্লিনিকাল উপস্থাপনা এবং প্যাথোজেনেসিস।

রক্তশূন্যতা হওয়ার সম্ভাব্য কারণগুলোঃ

রক্তক্ষয় হলে রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়া হতে পারে। অনেকদিন ধরে ধীরে ধীরে শরীর থেকে যদি রক্তের ক্ষয় ঘটতে থাকে তাহলে শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। এছাড়া ভিটামিন বি ও ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি, দীর্ঘমেয়াদি রোগ (যেমন কিডনি বিকল), দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ (যেমন যক্ষ্মা), ক্যানসার, থাইরয়েডের সমস্যা, অস্থিমজ্জায় সমস্যা, সময়ের আগে রক্তকণিকা ভেঙে যাওয়া, রক্তক্ষরণ ইত্যাদি হতে পারে রক্তশূন্যতার কারণ। মহিলাদের মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত অথবা সন্তান জন্মের সময় রক্ত ক্ষরণের কারণে হতে পারে। পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে এর হার বেশি। এতে বিরূপ প্রভাব পড়ে শিশুর ওপর, মাতৃমৃত্যুর হারও যায় বেড়ে। অপর্যাপ্ত লোহিত রক্তকণিকা উৎপন্নের কারণেও অ্যানিমিয়া হয়ে থাকে।

শরীরে আয়রনের ঘাটতি কেন হয়?

উপরের তথ্যগুলো পড়ার মাধ্যমে আমরা একটি বিষয় বুঝতে পারলাম যে, রক্তশূন্যতার অন্যতম একটি কারন হল শরীরে আয়রন এর ঘাটটি। খাদ্যে পর্যাপ্ত আয়রন না থাকলে বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের আয়রনের ঘাটতি হয়। আরেকটি কারণ নারীদের অতিরিক্ত মাসিকে রক্তক্ষরণ। অন্য কোনো কারণে দীর্ঘমেয়াদি রক্তক্ষরণ থাকতে পারে, যেমন – পেপটিক আলসার, কৃমি, পাইলস, অন্ত্রে বা পাকস্থলীতে ক্যানসার, দীর্ঘদিন ব্যথানাশক সেবন ইত্যাদি।

রক্তশূন্যতা কীভাবে বুঝবেন বা এর লক্ষণগুলো কি কি?

শরীরে রক্তশূন্যতা হলে সাধারণ কিছু লক্ষণ দেকা যায়। যেমন, চোখ-মুখ ফ্যাকাশে মনে হওয়া, দুর্বলতা, ক্লান্তি, অবসাদ, মাথা ঘোরা, মাথাব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, মুখে-ঠোঁটে ঘা, খাবার গিলতে অসুবিধা ইত্যাদি রক্তশূন্যতার সাধারণ লক্ষণ। রক্তশূন্যতার মাত্রা তীব্র হলে শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ লাগা এমনকি হার্ট ফেইলিউরও হতে পারে। রক্তশূন্যতা সন্দেহ করা হলে রক্তের একটি কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট করা জরুরি। এটি দেখে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ও লোহিত কণিকার পরিমাণ, আকার, রঞ্জক পদার্থের ঘনত্ব ও মান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক আরবিসি ইনডেক্স দেখে রক্তশূন্যতার কারণ অনুমান করতে পারেন। তবে প্রকৃত কারণ শনাক্ত করার জন্য পরে অন্যান্য পরীক্ষারও প্রয়োজন হয়।

রক্তশূন্যতার প্রতিকার কি?

শরীরে রক্তশূন্যতা প্রধান কারণ হলো আয়রনের ঘাটতি । তাই রক্তস্বল্পতা দেখা দিলে প্রচুর পরিমানে আয়রন যুক্ত খাবার খেতে হবে । তবে একমাত্র আয়রনের ঘাটতির কারনেই যে রক্তস্বল্পতা হয় এ ধারনাও ঠিক নয় । রক্তস্বল্পতা দেখা দিলে এর সঠিক কারন বের করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত । শরীরে আয়রন ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা হলে অনেকে আয়রন ট্যাবলেট খেয়ে থাকেন , তবে ইচ্ছামতো আয়রন ট্যাবলেট না খেয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাওয়াই ভালো।

শরীরে রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় খাবার কি কি?

রক্তশূন্যতার প্রতিকারে আয়রন জাতীয় খাবারঃ

সবুজ শাক-সবজিঃ সবুজ শাকে রয়েছে আয়রণ, প্রোটিন, ভিটামিন বি এবং ভিটামিন সি। এগুলো রক্তের জন্য খুব ভালো। তাই রক্ত ভালো রাখতে সবুজ শাকসবজি প্রত্যেকদিনের খাবারের তালিকায় রাখেবেন। কচু শাক শরীরে রক্ত বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত গাজর খান। এটি শরীরে আয়রন বৃদ্ধির সাথে সাথে ত্বকের জন্যও অনেক উপকারী। সিদ্ধ আলুতে আয়রণ পাওয়া যায়।

মধুঃ মধু আয়রনের একটি ভালো উৎস। আয়রন ছাড়াও মধুতে কপার ও ম্যাঙ্গানিজ আছে। এই উপাদানগুলো শরীরে হিমোগ্লোবিন প্রস্তুত করতে সহায়তা করে। তাই রক্তশূন্যতা দূর করতে প্রতিদিন ১ চামচ মধুর সাথে পরিমাণমত লেবুর রস মিশিয়ে পান করলে উপকারিতা পাওয়া যায়।

ফল-মূলঃ শরীরে লোহিত কণিকার উৎপাদন বাড়ানোর জন্য আয়রন সমৃদ্ধ ফল খাওয়া উচিত। জাম খেলে শরীরে রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। জামে থাকা আয়রন এবং ভিটামিন সি রক্ত পরিশোধন করতে সহায়তা করে এবং রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ায়। কমলা লোহিত রক্ত কণিকা বাড়াতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। তাছাড়া লিচু, কলা, আঙ্গুর ইত্যাদিতে প্রচুর আয়রণ থাকে।

অন্যান্য কিছু খাবার যেমনঃ কলিজা, মাংস, ডিম, সয়াবিন, বাদাম, সামুদ্রিক মাছ, খেজুর, কিশমিশ, আনার ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন রয়েছে যা দেহের রক্ত স্বল্পতা রোধ করে।

রক্তশূন্যতায় কেবল আয়রন বড়ি কিনে খাওয়াই উপযুক্ত সমাধান নয়। এর যথাযথ চিকিৎসার জন্য কিসের অভাবে রক্তস্বল্পতা হচ্ছে সেটা আগে জানতে হবে এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসাগ্রহন করতে হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিশুদের বেড়ে উঠা ও নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য একটা বড় হুমকি হলো আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা। অথচ এর সমাধান খুব সহজ, শুধু দরকার একটু সচেতনতা। বিশেষ প্রয়োজনে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

সংগৃহীত