অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে যেকোনো উৎসব, অনুষ্ঠানে কোমল পানীয় পান করা অত্যাবশ্যকীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটু তৃষ্ণা মেটাতে এক চুমুক ঠাণ্ডা কোমল পানীয় বা এনার্জি ড্রিংকসে কমবেশি অনেকেই স্বস্তি খোঁজেন। অথচ এর না আছে পুষ্টিগুণ আর না আছে পানিশূন্যতা দূরীকরণের ক্ষমতা। উল্টো এর প্রতিটি চুমুকেই রয়েছে মানবদেহের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব। অতিরিক্ত ঠাণ্ডা পানীয় পান করলে শরীরের অনেক ক্ষতি হয়। এসব কোমল পানীয় স্বাস্থ্যের জন্য শুধু ক্ষতিকর নয় বরং মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
এছাড়া গরমের সময় কোমল পানীয় খাওয়ার চাহিদা অনেকটা বেড়ে যায়। বাইরে বেরোলে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা কোমল পানীয় প্রচুর খাওয়া হয়। কোমল পানীয় খেয়ে হয়ত সামান্য সময়ের জন্য স্বস্তি পাচ্ছেন। তবে ডেকে আনছেন ভয়াবহ শরীরিক ক্ষতি। কোমল পানীয় ছোট-বড় সবার জন্য ক্ষতিকর। শিশুদের এই ঠাণ্ডা পানীয় থেকে দূরে রাখাটাই ভালো।
কোমল পানীয়র ইতিহাস অর্ধশতকালের। পানি, চিনি, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, লেবুর জুস দিয়ে প্রথম তৈরি করা হয় এনার্জি ড্রিংকস। যুগের পরিবর্তনে এতে এসেছে উপাদানগত পরিবর্তন। যোগ হয়েছে ক্যাফেইন, কখনো বা ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল, অপিয়েট। ক্যাফেইন যোগ করার কারণ হলো, এটি মস্তিষ্ক উত্তেজিত করে। ফলে নিজের মধ্যে ভালো লাগা শুরু হয়।
বর্তমানে কোমল পানীয় তৈরী করা হয় কার্বন ডাইঅক্সাইডকে অতিরিক্ত চাপ দিয়ে পানির মধ্যে দ্রবীভূত করে। তখন বুদবুদ উঠতে থাকে। কার্বন-ডাই-অক্সাইড আমরা শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় শরীর থেকে বর্জ্য হিসেবে বের করে দিই। অথচ কোমল পানীয় পানের মাধ্যমে এটি শরীরে প্রবেশ করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোমল পানীয়তে চিনি মেশানো হয়। সেই চিনি শরীরের জন্য একদমই ভালো নয়।
কোমল পানীয় পানের ক্ষতিকর দিকঃ
দাঁতের ক্ষতিঃ
চিনি ও অম্লীয় উপাদান দুটোই প্রচুর পরিমাণে থাকে কার্বোনেইটেড পানীয়তে। দুটোই দাঁতের চরম শত্রু। তাই দাঁতের ক্ষয় ও সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে কোমল পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। কোমল পানীয়তে ফসফোরিক এসিড ও কার্বনিক এসিড থাকে। এটি মুখে আম্লিকতা বাড়ায় যা দাঁতের ক্ষতি করে।
পাকস্থলীর ক্ষতিঃ
খাদ্য হজমের ক্ষেত্রে কৃত্রিম পানীয়ের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু কৃত্রিম পানীয় সাময়িক স্বস্তি দিলেও এটি প্রকৃতপক্ষে পাকস্থলীর ভারসাম্য নষ্ট করে। তাছাড়া এই ধরনের পানীয় শরীরের ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমিয়ে দেয় যা পরবর্তীতে হাড়ের ক্ষয়জনিত সমস্যা সৃষ্টি করার পাশাপাশি ক্ষুধামন্দা, অম্লতা বা অ্যাসিডিটি বা মেদবৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
ডায়বেটিস ও হৃদরোগঃ
নিয়মিত কোমল পানীয় পান করলে টাইপ-টু ডায়বেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। আমেরিকান ডায়েট অ্যাসোসিয়েশনের গবেষণা অনুযায়ী, নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস মেনে চলার মাধ্যমে এই ঝুঁকি কমানো সম্ভব, তবে পুরোপুরি নাকচ করা সম্ভব হয় না। কোমল পানীয় হৃদরোগ ও ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
একই গবেষণায় আরও জানা যায়, কোমল পানীয় ‘মেটাবলিক সিন্ড্রোম’ বা বিপাকীয় প্রক্রিয়ার বিভিন্ন সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়, যা ক্রমেই ঠেলে দেয় হৃদরোগের দিকে এর সাথে রয়েছে উচ্চ রক্তপচাপের আশঙ্কাও।
যৌন সমস্যাঃ
কোমল পানীয়তে থাকা সিলডেনাফিল সাইট্রেট ধীরে ধীরে যৌনশক্তি নিঃশেষ করে ফেলতে পারে। আর অপিয়েট ও অতিরিক্ত ক্যাফেইন মানুষকে ধীরে ধীরে কড়া নেশার জগতে ধাবিত করে। এনার্জি ড্রিংকস পুরুষদের ক্ষেত্রে যৌনশক্তি হ্রাস, সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা তৈরী করে।
হরমোনের ক্ষতিঃ
অতিরিক্ত ঠান্ডা কোমল পানীয় খেলে, শরীরের বিভিন্ন হরমোন গ্রন্থিগুলির উপর প্রভাব ফেলে। হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে মহিলাদের সন্তানধারণে নানা রকম জটিলতা সৃষ্টি করে। শুধু হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হওয়াই নয়, বোতলবন্দি এই কোমল পানীয়গুলো শরীরের বিপাক হার এবং প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। ফলস্বরূপ মহিলা এবং পুরুষদের মধ্যে স্থূলত্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। শুধু সন্তানধারণই নয়, কিছু ক্ষেত্রে গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
পুরুষদের শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যায়। কোমল পানীয় খেতে অভ্যস্ত এমন পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা, যারা কোমল পানীয় খান না তাদের তুলনায় অনেক কম। এই জাতীয় পানীয়ে ক্ষারত্বের মাত্রা বেশি থাকে। কোমল পানীয় অতিরিক্ত মাত্রায় খেলে শরীরের পিএইচের ভারসাম্য নষ্ট হয়। যার প্রভাব পড়ে পুরুষদের শুক্রাণুর উপর।
বৃক্ক ও যকৃৎঃ
প্রতিদিন একবার কার্বোনেইটেড পানীয় খাওয়াই কিডনি বা বৃক্কে পাথর হওয়া এবং অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত করার জন্য যথেষ্ট। যকৃতের বিভিন্ন রোগের জন্যও বিশেষভাবে দায়ি অতিরিক্ত কোমল পানীয়। স্থূলতা এবং হাড়ের ক্ষয়ও অতিরিক্ত কোমল পানীয় পানের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া।
চিকিৎসকদের মতে, বিশ্বজুড়ে গত কয়েক দশকে সব বয়সী বিশেষত শিশুদের মধ্যে কিডনি রোগ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো এই কোমল পানীয়।
অর্থের অপচয়ঃ
কোমল পানীয়ের দাম বেশি। এর পেছনের অর্থ অপচয় না করে একই খরচে ডাবের পানি, তাজা ফলের শরবত পান করার চেষ্ট করতে হবে। একটু ভিন্ন স্বাদ পেতে চাইলে মসলা চা, গ্রিন টি বেছে নিতে পারেন। এতে একদিকে স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, অপরদিকে নিম্নবিত্ত ডাব বিক্রেতা, শরবত বিক্রেতাও উপকৃত হবে।
এছাড়া, কোমল পানীয়ের পরিবর্তে টক দইয়ের তৈরি ঠাণ্ডা পানীয় হিসেবে বোরহানিও খেতে পারেন। এতে ক্ষতি নয় বরং মিলবে প্রশান্তি এবং নানা স্বাস্থ্য উপকারিতা।
পরিবেশগত সমস্যাঃ
সমস্যাটি আমাদের সরাসরি প্রভাবিত না করলেও, ছোটখাট অবহেলার কারণেই পরিবেশের ক্ষতি হয়। কার্বোনেইটেড পানীয় তৈরিতে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়, এ থেকে সৃষ্ট বর্জ্যও যায় পানিতেই। অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি ক্যান পুরোপুরি রিসাইকেল করা সম্ভব হয় না। আবার অ্যালুমিনিয়াম সংগ্রমের প্রক্রিয়াও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। আর যেখানে সেখানে কোমল পানীয়ের বোতল, ক্যান ফেলার কুপ্রবাব তো আছেই।
চিকিৎসকের মতে, শরীর স্বাস্থ্য ভাল রাখতে প্রতিদিনের খাবারের তালিকা থেকে কোমল পানীয় একেবারেই বাদ দিতে হবে। কারন, কোমল পানীয় দীর্ঘদিন পান করলে ধীরে ধীরে স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। গর্ভবতী নারীর সন্তান বিকলাঙ্গ হতে পারে। খাওয়ার রুচি নষ্ট হতে পারে, মেজাজ হয়ে উঠতে পারে খিটখিটে। উপরন্তু, শিশুদের জন্যে এগুলো খুবই ক্ষতিকর।
Leave a Reply